অনুভূতির কিছু কথা
আমার অনুভূতির কথা বলি…..
১৯৭৫ এর আগষ্ট।
৪ তারিখ মা হঠাৎ চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
একটা শূন্যতা বুক জুড়ে।
বাবা আগলে রেখেছেন তাঁর বুকের উষ্ণতা দিয়ে।
আমি তখন স্কুল বয়।
বঙ্গবন্ধু- ইন্দিরা গান্ধীর ছবি সহ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক গুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতাম।
এটা যেন আমার প্রতিদিনের খেলার অংশ ছিল।
১৫ তারিখ সকাল রেডিওটা ওপেন করতেই শুনি বঙ্গবন্ধু সহ পুরো পরিবার নেই।
ছোট্ট মনটা হু হু করে উঠলো।
অন্যরকম শূন্যতা পুরো মন জুড়ে।
রেডিও শুনি, পত্রিকা পড়ি।
বিভিন্ন খবর পাই।
পত্রিকায় দেখি টুপির ছবি।
শুনলাম…..
এটা নাকি জাতীয় টুপি….
মোসতাক টুপি।
পুরো জাতিকে যেনো
মীর জাফরের টুপি পরিয়ে দেওয়া হলো।
মন ভালো নেই।
স্কুলে যাই,গান বাজনা করি,
স্কাউটিং করি,কচিকাঁচা করি,সন্দীপনে গান শিখি।
নভেম্বর মাস…..
হঠাৎ মিছিলে শ্লোগান
রব, জিয়া, জলিল……
তারপর দিন যায়।
আবারও মিছিল….
এবার শ্লোগান শুধুই জিয়া।
রব জলিলের নাম নেই।
হঠাৎ শুনলাম উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আসবে ফেনী পাইলট হাই স্কুল ও ফেনী কলেজ কম্পাউন্ডে।
আমি ফেনী পাইলট হাই স্কুল কাব- স্কাউট টিমের লিডার।
গার্ড অব অনার দিতে হবে।
আমার নেতৃত্বে কাব-স্কাউট ট্রুপ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে স্কুল গেইটের পাশে বাস্কেট বল মাঠে।
অবশেষে….
তিনি এলেন।
তিনি DCMLA জিয়া….
আমার সামনে উনি দাঁড়িয়ে।
স্যালুট দিলে হ্যান্ডসেক করতেই আচমকা
আমার বুকের উপর তাঁর বাম হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করে ভারী গলায় বল্লেন ‘তোমাকে শক্ত হতে হবে,শক্ত হতে হবে।
ততক্ষনে হালকা, পাতলা, লম্বু আমি ব্যাথায় কঁকিয়ে বুকে হাত দিতে বসে পড়লাম।
তারপরও অন্য রকম একটা শিহরন আমার শরীর জুড়ে।
একেতো আমি স্কুল বয়।
রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝিনা।
জিয়া ফেনী এলেই চলে যাই….
যেনো হ্যামিলনের বংশীবাদক।
পিছনে পিছনে হাঁটি।
মাথায় ক্যাপ,কালো সানগ্লাস,সাফারী গায়ে।
হাতে রাষ্ট্রপতি সিগারেট।
আনাড়ী ভাবে জ্বলন্ত সিগারেটে দু’তিন টান দিয়ে ফেলে দিতেন।
আর তখন সবে মাত্র কাজী জাফর আহম্মেদ জিয়া দলে শিক্ষা মন্ত্রীত্বের পদও ছেড়ে দিয়েছেন।
এদিকে ততদিনে আব্বা ফেনী হতে কুমিল্লায় নতুন কর্মস্থলে বদলী হলেন।
আমারও স্কুল বদল হলো।
ফেনী পাইলট হতে আমি চলে গেলাম কুমিল্লা জিলা স্কুলে।
তখন আমার কাছে মনে হতো অাফজল খাঁন কুমিল্লার জয়নাল হাজারী।
কারন ফেনী হতে জয়নাল হাজারীকে চিনতাম বলেই আমার অমনটি মনে হতো।
তা’ছাড়া ফারুক হাজারী,ইলিয়াস হাজারী,গিয়াস হাজারী,মোসাদ্দেক হাজারী,ইফতেখার,বিষ্ণু,শানু,মাসুম,শাহীন,জাফর সহ আমরা বন্ধুরা ফেনী জুড়ে।
এদিকে কুমিল্লা জিলা স্কুলে এসে আমি স্কাউটিং এর পাশাপাশি জুনিয়র রেডক্রস করি।
নজরুল ইন্সটিটিউটে গান শিখি।দেয়াল টপকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কুমিল্লা স্টেডিয়ামের ভিতর দিয়ে লেডি ফাতেমার দিকে চলে যাই।
একদিন আমাদের জানানো হলো জিয়া আসছে।
খাল কাটা কর্মসূচীতে।
দাউদকান্দি গৌরীপুরে খন্দকার মুসতাকের বাড়ী কাছে সুন্দরপুরে তিনি খাল কাটবেন।
আমাদেরও অংশ নিতে হবে ঐ খালকাটা কর্মসূচীতে।
মটর শূটির ক্ষেত মাড়িয়ে হাজার হাজার লোকের সাথে আমরাও অংশ নিলাম জিয়ার সেই খালকাটা কর্মসূচীতে।
তখনও বুঝিনি জিয়া শাসনের নিষ্ঠুরতার কথা।
গ্রামের বাড়ী যাওয়ার সময় জাঙ্গালিয়া পেরিয়ে
ভোর বেলায় শুধুই দেখতাম ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট হতে লরীতে করে যাচ্ছে লাশের পর লাশ।
শুধু জানতাম জিয়ার বিদ্রোহী সৈনিকদের ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে মৃত্যুদন্ডের পর লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেনা লরীতে লালমাই পাহাড়ের দিকে।
তখন কুমিল্লা ক্যান্ট এর জিওসি প্রান-আরএফএল গ্রুপে প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল আলী আমজাদ খান।
যতটুকু মনে পড়ে ময়নামতি পাহাড়ে তাঁর অফিস।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়।
ততদিনে আব্বা বদলী হলেন কুষ্টিয়ার চূয়াডাঙ্গা হয়ে নোয়াখালীর মাইজদীতে।
ততদিনে আমি নোয়াখালী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র।
আমার এইচ এস সি পরীক্ষা।
ক্যামেষ্ট্রি পরীক্ষা দিচ্ছি।
পরীক্ষার হলে বসেই খবর পেলাম জিয়া চিটাগাং এ নিহত।
আমরা ঢাকা হতে বিচ্ছিন্ন।
কেন জানি মনটা কষ্টে ভরে গেলো।
কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ নেই।
একেতো এইচ এস সি পরীক্ষা।
অন্যদিকে চিটাগাং এডমিনিস্ট্রেশনের নিয়ন্ত্রনে আমরা।
তারও অনেক পরে।
পরীক্ষা শেষ।
স্বাভাবিক অবস্থা দেশ জুড়ে।
সাত্তার প্রশাসন।
সময় না যেতেই এরশাদ প্রশাসন।
ততদিনে জিয়ার কফিন সমাহিত সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক পেরিয়ে সবুজ ফাঁকা চত্বরে।
আর্মি পাহারায় কবরটি।
ঢাকা এসে ঐ কবরটি দেখতেও যাই।
দিন বয়ে যায়।
রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন….
ক্রমশঃই রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের পাশাপাশি সলিমুল্লাহ খান,মেজবাহ কামাল,নূরুল ইসলাম মন্জু স্যার,ডঃশাহ আলম স্যার,ডঃমিজান স্যার,পুতুল আপা(ছাত্র নেতা অভির বোন)’র সহাচর্যে এসে রাজনীতির বই গুলো পড়ছি,মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও সেতুং কে চিনছি।
এক সময় আমি চলে গেলাম সলিমুল্লাহ খানের ভাবশিষ্যত্ব নিয়ে প্র্যাক্সিস স্টাডি সার্কেলে।
আমাদের অনেকেই চলে গেলো বদরুদ্দিন উমর স্যার এর লেখক শিবিরে।
সাথে সাথে আমি ক্যাম্পাস জুড়ে জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে ততদিনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী।
এখন জিয়াকে চিনি,এরশাদকে চিনি।
রব ভাই,জলিলকে চিনছি।
ইনু ভাই,শিরিন আপা,মোসতাক ভাই,প্রধান ভাই, মোহন রায়হান ভাই, বকু ভাই,আজু ভাই,শাহজাহান সিরাজ আমার রাজনীতির নায়ক।
প্রদীপ,পাপুল,রায়হান,আজাদ,পনির,
কাইয়ূম,মুঈদ,আয়ূব,করিম সিকদার,বাদল,নওশাদ,রুহুল কুদ্দুস বাবু ভাই সহ আমরা জাসদ ছাত্রলীগ।
সময় বয়ে যায়……
এখন আমি বুঝি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একমাত্র
বঙ্গবন্ধুর নির্মোহ রাজনীতিই শুদ্ধ রাজনীতি।
তাই আমি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী হয়েও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারন করে নিজের অবচেতন মনেই চলে যাই রক্তাক্ত বত্রিশ নম্বরে এবং
নির্দ্বিধায় বলতে পারি…..
জয় বাংলা,
জয় বঙ্গবন্ধু।