কাশফুল এগ্রোর সফলতার গল্প!
যে মানুষটা কে দেখে গ্রামের লোকজন হাসতো, বলতো পাগল হয়ে গেছে, সেই আজ সেই গ্রামের সব থেকে অনুপ্রেণার, যার ছোয়াতে পুরো গ্রামের চেহারাই পাল্টে গেছে তার নাম সাইদুল ইসলাম, যিনি এই কাশফুল এগ্রোর মালিক।
কতটা ভালবাসলে একটা ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্সে বি.বি.এ- এম.বি.এ পাশ করে চাকরী বাকরী ছেড়ে এই ভালবাসাকে প্রশ্রয় দেয়, একটা কথা বার বার অভিজ্ঞরা বলে ভাল না বাসলে এই ব্যবসা হবেনা। তারই এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হচ্ছে সাইদ। ২০০৩ এ লেখা পড়া শেষ করে ৭ বছর চাকরী করেন, ৪ ভাই ২ বোন আর মা বাবা সহ একটা সংসার।
মধ্যবিত্ত পরিবারেই বেড়ে ওঠা। মন চাইলে যে একটা কিছু করে ফেলবে তার কোন উপায় ছিলনা। তাই লেখা পড়া করা অবস্থায় টিউশনি করেই সংসারের অনেক খরচ নিজেই বহন করার হাল ধরেছিলেন। পাশাপাশি বাড়ির ছাদে কবুতর, খরগোশ, ছাগল পুষতেন। এই পোষা প্রানী নিয়ে বিরক্ত হয়ে বাবা তো একদিন ঘর থেকেই বের করে দিয়েছিল।
যাই হোক, লুকায়ে লুকায়ে যেটুকু করা যেত ছোট করে সেটুকু করে যেতেন। এরপর ঢাকাতে চাকরীতে ঢুকেও হাসফাস, মন বসে না। গ্রামে গেলেই রহমত আর মতিন কে দেখতেন ৩ টা গরু পুষে বছরে ১.২০ লাখ টাকা লাভ করে আসছে বিগত ৯ বছর ধরে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন গরুর ফার্ম করবেন। বাসার লোকজনদের জানাতেই সবাই এক কথায় না, করা যাবেনা। সাইদ পাগল হয়ে গেছে, চাকরী বাকরী ছেড়ে কেউ এসব করে নাকি!!! কি আজব!
কাউকে কিছু না বলে সহধর্মিণী কে বলল, শুনো ছেলে পেলেরা কত কিছু করে দিন শেষে, আড্ডা দেই, নেশা করে। আমাকে দেখেছো এসব কিছু করতে? সহধর্মিণী বললেন, না। সাইদ বললেন, আমার তো একটাই শখ, তুমি চাওনা আমি এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, ভাল একটা কিছু করি? সহধর্মিণী আর না বলতে পারেনি। রামপুরার বাসা ছেড়ে সিদ্ধান্ত নিলেন নারায়নগঞ্জের বড়ইকান্দিতে একটা ভাড়া করা সেড পাওয়া গেছে সেখানে গিয়ে একটা ফার্ম করবেন। বাসার মালামাল ট্রাকে করে সোজা চলে গেলেন সেখানে।
শুরুটা যেভাবেঃ ২০১০ এর মে মাসে ১০,০০০ টাকা ভাড়া দিয়ে ৩৫ টা গরু করা যাবে এমন একটা সেড নিলেন। কিছু গীর জাতীয় ষাড় গরু তোলা শুরু করলেন, আর এভাবে করে ১৫ টি ষাড় কিনে ফেললেন। দিন যায় দিন যায়, একদিন হঠাৎ করে দেখেন ফার্ম এ এফ,এম,ডি দেখা দিয়েছে। ডাক্তার কে দিতে হবে ১০০০ টাকা ভিজিট, না হলে আসবে না। এভাবে চিকিৎসা করাতে গিয়ে এক ধাক্কায় ২৫,০০০ টাকা চলে গেল। এরপর কিছুদিন যেতে না যেতেই একদিন দেখে গরুগুলা ঠিক মত খাচ্ছেনা। হঠাৎ করে একটা গরু মারাও গেল। সাইদ মানসিক ভাবে খুব ভেংগে পড়ল। বাসার সবাই গালমন্দ শোনাতে ছাড়েনি।
কি সমস্যা কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। গ্রামের মানুষজন সাইদকে ডেকে বলল, একটা কবরের উপর নাকি এই ফার্ম টা করা হয়েছে আর এর জন্য আগের খামারীও নাকি ২০ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে চলে গেছে। যত তাড়াতাড়ি পারে যেন এই ফার্ম অন্য কোথাও নিয়ে যায়। সাইদ মোটামুটি দিশেহারা হয়ে সব গরুগুলোকে তার গ্রামে নিয়ে গেলেন। খুব কম খরচের মধ্যে একটা গোয়াল ঘর বানানো হল যেখানে ২৫ টা গরু রাখা যাবে। আল্লাহ্র কি রহমত, শুধু জায়গা পরিবর্তন এর পর সব গরুগুলা ঠিকমত খাওয়া ধরল আর সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল।
সাইদকে জিজ্ঞেস করলাম আগের জায়গাটা এখনকার থেকে নিশ্চয় খারাপ ছিল! সাইদ বলল, আগের জায়গাটা নাকি এখনকার থেকে অনেক ভাল ছিল। আমিতো ভাই শুনে অবাক। হা আসলেই এই নতুন জায়গায় ফার্ম এর খারাপ অবস্থাকে পাল্টে দিল। বিশ্বাস না করলেও ব্যাপারটা সত্য। ২০১১ তে এই গরুগুলো বিক্রি করে ২.৫০ লাখ টাকা লোকসান দিতে হল, যদিও হিসেব ছিল লোকেসান আরো বেশী হবে এই নানান সমস্যার কারনে। বাসার সবাই আবারো গালমন্দ, ঢাকা ইউনিভারসিটি তে তাহলে কেন পড়লি, এই ফালতু ব্যবসা করার জন্য!!! সাইদের মন খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু আত্ম বিশ্বাস কমেনি।
সাইদ নিজের ভুল গুলো বোঝার চেস্টা করল আর পরের বার একটা জমি বিক্রি করে ৩৫ টা দেশী ষাড় গরু কিনে আবার ব্যবসা শুরু করলেন। ২০১২ তে গরুর বাজার অনেক খারাপ ছিল বলে এবারো ২ লাখ টাকা লোকসান দিল। বাসার সবাই আবারো গালমন্দ, বলা শুরু করল সবাই ব্যবসা করে জমি কেনে আর তুই জমি বিক্রি করে এই ফালতু ব্যবসা শুরু করছিস। সাইদ খাতা কলম নিয়ে তার ভুলগুলা লেখা শুরু করল। এরমধ্যে একটা বড় ভুল ছিল সেটা হল, গরু প্রতি খাবার খরচের কোন হিসাব তার করা ছিলনা।
এর পরের বার ২০১৩ তে সব ভুল শুধরে ৭৫ টা শাহিওয়াল জাতের গরু কিনল। এই ২০১৩ তে বিগত সব বছরের লোকসান তুলে ৩ গুন লাভ করে ফেললেন। ২০১৪-১৫ তে সাইদকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাইদ এখন তার নিজের বাড়ি করার কাজে হাত দিয়েছে, ধান, হলুদ, মরিচ, পেয়াজ আর বড় আমের বাগান ও করেছে। যে গ্রামের মাত্র ১০% লোক এই ব্যবসা করত, সেই গ্রামে আজ ৮০% লোক সাইদকে দেখে গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসা করে সাবলম্বি হয়েছে।