মোটরযান বীমা ঃ বাতিল নাকি বাধ্যতামূলক


সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুসারে কোন মোটরযানের বীমা পলিসি না থাকলে মামলা নয়; এমন অনুরোধ জানিয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর’২০২০ইং তারিখে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে চিঠি দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। বাংলাদেশ সড়ক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এমন অনুরোধ পেয়ে তা বাস্তবায়ন শুরু করে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বীমা পলিসি বা Act Liability Insurance পলিসি বন্ধের নির্দেশ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ফলে সর্বমহলে এমন ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে, মোটরযানের বীমা পলিসির প্রয়োজন নেই। অথচ বীমা বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে- মোটরযানের বীমা প্রয়োজন নেই, বিষয়টা এমন নয়; বরং সড়ক পরিবহন আইনে মোটরযান বীমাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মোটরযানের তৃতীয় পক্ষের বীমা পলিসি বাতিল নাকি বাধ্যতামূলক- তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইন- ১৯৮৩ রহিত করে সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার। পূর্বের আইনের ১০৯ নং ধারায় মোটরযান বীমা বাধ্যতামূলক ছিল। তাছাড়া উক্ত আইনের ১৫৫ ধারায় মোটরযান বীমা পলিসি না থাকলে কি ধরণের শাস্তি ও জরিমানা হবে তার উল্লেখ ছিল। কিন্তু এই বীমা পলিসির আওতায় ক্ষতিপূরণের অংক বর্তমান প্রেক্ষাপটে কম হওয়ায় অর্থাৎ মৃত্যুজনিত দাবীর ২০,০০০/- সিভিয়ার ইনজুরী ও তৃতীয় পক্ষের সম্পত্তি নষ্ট হলে যথাক্রমে সর্বোচ্চ ১০,০০০/- ও ৫০,০০০/- টাকা হওয়ায় বীমা কোম্পানির কাছে খুব কমই বীমা দাবী উত্থাপিত হয়। কেননা আমাদের দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ উক্ত মোটরযান বীমার ক্ষতিপূরন সম্পর্কে সচেতন নয়। তাছাড়া, বীমা দাবী উত্থাপনের ক্ষেত্রে দূর্ঘটনার প্রমান ও উত্তরাধিকার সনদপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়ার বিষয়টি ঝামেলাপূর্ন মনে করে বীমাগ্রহীতা বীমাদাবী উত্থাপনের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত বোধ করে থাকেন । এজন্য হয়তোবা ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনে মোটরযানের বীমা করাকে ‘ঐচ্ছিক’ করা হয়েছে। পরবর্তীতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ইং সনে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে মোটরযানের বীমা না থাকলে মামলা নয়’ এমন একটি পত্র প্রেরণ করা হলে মোটরযান বীমা সম্পর্কিত শাস্তি ও জরিমানা বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ পুলিশ প্রশাসন । এরপর গত ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ইং সনে একটি সার্কুলার জারি করে তৃতীয় পক্ষের মোটরযানের বীমা ঝুঁকি বাতিল করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। মূলত তখন থেকেই তৃতীয় পক্ষের মোটর বীমা ঝুঁকি (3rd Party বা Act Liability Insurance) বন্ধ হয়ে যায়, শুধু মাত্র ব্যাংক লোন নিয়ে গাড়ী ক্রয় করলে বা খুবই সচেতন গাড়ীর মালিকগন 1st Party Insurance (Comprehensive) বীমাপত্র নিচ্ছে বা পূর্বের পলিসির 1st Party Insurance (Comprehensive) কিছু কিছু ক্ষেত্রে নবায়ন করছেন।
সম্প্রতি মোটরযান বীমা বিষয়ে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে বীমা খাতে। বীমাবিদদের মতে, আইনের কিছুটা অস্পষ্টতার সুযোগে মোটরযান বীমা ছাড়াই সড়কে গাড়ি চালানো মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে কোন দূর্ঘটনা ঘটলে মোটর গাড়ির মালিকের যেমন ক্ষতিপূরণ সম্ভব হবে না, তেমনি অন্যকোন তৃতীয় পক্ষের সম্পদের বা জীবনের ক্ষতি হলে সেটাও ক্ষতিপূরণের আওতার বাইরে থাকছে। সেক্ষেত্রে গাড়ির মালিককে দুই ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। প্রথমতঃ নিজের গাড়ির ক্ষতি, দ্বিতীয়তঃ অন্য তৃতীয় পক্ষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতির দায়। তাছাড়া, আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মোটরযান বীমা পলিসি ছাড়া সড়কে গাড়ি চলাচল করতে দেয়া হয় না।

তবে অধিকাংশ বীমা ব্যক্তিদের মতে- নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বীমার বিষয়টি স্পষ্ট রয়েছে এবং তা বাধ্যতামূূলক। কেননা, সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ এর ৬০(২) ধারায় মোটরযান মালিককে উহার অধীনে পরিচালিত মোটরযানের জন্য ‘যথানিয়মে বীমা করিবেন’ কথাটি বলা হয়েছে। পাশাপাশি ধারা ১১১ তে পুলিশ অফিসার দ্বারা গাড়ির কাগজপত্র আটকের ক্ষমতার ক্ষেত্রে ‘বীমা সনদ’ কথাটির উল্লেখ রয়েছে। ফলে এ দুই ধারার বিশ্লেষণ থেকেই মোটর বীমা ‘বাধ্যতামূলক’ বলে জানান তারা।

তবে কেউ কেউ এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা বলেন, আইনটির- ১১১ নং ধারায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিদর্শক গাড়ির কাগজপত্র জাল বা ভূয়া প্রমাণিত হলে এর জন্য কৈফিয়ত তলব করতে পারবেন। কিন্তু কোন শাস্তির বিষয়ে বলা হয়নি। যেহেতু নতুন সড়ক আইনে বীমা বিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে তা অস্পষ্ট এবং এজন্য কোন শাস্তি বা জরিমানার বিধান রাখা হয়নি- তাই বীমা পলিসি ছাড়া গাড়ি চালাতে পারবে না বা মোটরযান বীমাপলিসি বাধ্যতামূলক; এমনটা বলার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে আইনের ধারাগুলো স্পষ্ট করতে এবং প্রয়োজনে নতুন করে নির্দেশনা জারি করতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মিলিত বৈঠক হওয়া এবং সে বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করা প্রয়োজন।

বিষয়টি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও নিটল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান জনাব এ কে এম মনিরুল হক জানান- নতুন সড়ক আইনেও মোটরযানের বীমা পলিসি বাধ্যতামূলক। কিন্তু এতে শাস্তির কোন বিধান না থাকায় বিষয়টি নিয়ে দ্বিধার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বিষয়টি স্পষ্ট করতে বিআরটিএ, আইডিআরএ এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রয়োজনে আইন সংশোধন অথবা নতুন করে কোন দিক-নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন জারি করা প্রয়োজন।

এমনটাই মনে করেন কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সের ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিআইএর প্রথম সহ-সভাপতি জনাব নাসির উদ্দিন আহমেদ পাভেল। তিনি বলেন- যেহেতু ৬০(২) ধারায় গাড়ি মালিকের প্রতি ‘যথানিয়মে বীমা করিবেন’ বলে নির্দেশনা রয়েছে, তাই এটা বাধ্যতামূলক। তবে বিষয়টি আরো স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। যদি মোটরযান বীমা বাধ্যতামূলক হয় তবে আইডিআরএ এই বীমা পলিসি কেন বন্ধ করেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- আগে মোটরযান বীমা পলিসিগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। মোটরযান বীমায় সাধারণ দু’ধরনের পলিসি চালু ছিলো। একটি হলো Comprehensive বা ব্যাপক ঝুঁকি আবরিত বীমা পলিসি এবং আরেকটি হলো শুধু মাত্র Act Liability বা তৃতীয় পক্ষের বীমা পলিসি । Comprehensive মোটর পলিসিতে আবার 1st Party এবং 3rd Party -র ঝুঁকি কভার করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ মোটর গাড়ির নিজস্ব ক্ষতি এবং তৃতীয় পক্ষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি বা দায় কভার করা হয়ে থাকে। বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুসারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) শুধুমাত্র তৃতীয় পক্ষের মোটরযান বীমা পলিসি বা Act Liability পলিসি বন্ধ ঘোষনা করেছেন। কারণ Comprehensive মোটরযান বীমা পলিসিতে তৃতীয় পক্ষের ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা রয়েছে। একই বীমা দুই বার না রেখে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বরং যুগপোযোগী কাজটিই করেছেন।

রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব পি কে রায়, এফসিএ বলেন- সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৬০ ধারার ১ উপধারায় গাড়ির যাত্রী ও তাদের সম্পদের বীমা করার বিষয়টি ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। কেননা ৫৩ ধারায় সরকার যেহেতু যাত্রী বা অন্য সম্পদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে তহবিল গঠন করবে তাই পুনরায় তাদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়টি গাড়ি মালিকের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। কিন্তু ৬০(২) ধারায় গাড়ির যথানিয়মে মোটরযান বীমা করার বিষয়টি আইনে রাখা হয়েছে। আবার ৬০(৩) ধারায় বলা হয়েছে- গাড়ির মালিক ৫৩ ধারায় গঠিত তহবিল থেকে কোন ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারবেন না। এখান থেকে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়- গাড়ির মালিক কোন ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেননা। মূলত এ অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতেই ৬০(২) ধারায় গাড়ির মালিকদের ‘যথানিয়মে’ মোটরযান বীমা করার বিষয়টি রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের মহাসচিব এবং এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মোঃ ইমাম শাহীন মনে করেন – সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ খসড়া করার পর্যায় থেকে আইনটি পাশ করা পর্যন্ত যদি বীমা খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের যৌক্তিসংগত পরামর্শ যথাসময়ে গ্রহন করা হতো তাহলে, পাশকৃত আইনে মোটরযান বীমা বিষয়ে যে অস্পষ্টতা বা ধু¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে’ তা হওয়ার সুযোগ থাকত না।

হ্যাঁ, 3rd Party Insurance বা Act Liability Insurance এ বীমা প্রিমিয়াম ও ক্ষতিপূরনের সর্বোচ্চ সীমা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী না হওয়ায় বা বীমাগ্রহীতা 3rd Party Insurance এর বীমা দাবী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় যে হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত বা মৃত্যুবরন করেন তার শতকরা আনুমানিক ১০ (দশ) ভাগ বীমাদাবীও বীমা কোম্পানি পর্যন্ত পৌঁছায় না, যার দরুন তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা (3rd Party Insurance ev Act Liability Insurance) পৃথক ভাবে রাখার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাই বলে বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইনের গভীরভাবে বিশ্লেষন এবং তার প্রায়গিকতা উপেক্ষা করে বীমা সনদ ছাড়াই রাস্তায় গাড়ী চলবে? বিশ্বের কোন দেশে বীমা সনদ ছাড়া রাস্তায় গাড়ী চলাচল করে তা আমার জানা নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে বীমা সনদ বিহীন গাড়ী কর্তৃক সড়কে দূর্ঘটনায় পথচারী বা তৃতীয় পক্ষের জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতি হলে তার দায় দায়িত্ব কে নিবে? এমন পরিস্থিতিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ পুলিশ প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশণের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলোচনাপূর্বক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে উদ্ভুত পরিস্থিতির সমাধান প্রয়োজন এবং বীমা সনদ ছাড়া রাস্তায় গাড়ী চলাচলের বিধি-নিষেধ সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দূর করে যথাযথ প্রজ্ঞাপন জারি করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তা না হলে, একদিকে বীমা খাতে মোটরযান বীমায় প্রিমিয়াম আয় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে, অন্যদিকে সরকার বিপুল পরিমানে রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যথায় জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান বা Penetration কাঙ্খিত পর্যায়ে নেবার উদ্যোগ ব্যাহত হবে।