শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ও শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি রুট ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ ৪৫০ স্পিডবোট চালকদের লাইসেন্স ও স্পিডবোটের ফিটনেস তদারকির আওতায় না আসায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘনা আতঙ্কে পারাপার হচ্ছে যাত্রীরা।


পদ্মা নদীর শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ও শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি রুটে চলে প্রায় সাড়ে ৪৫০ স্পিডবোট চলাচল করে। যার একটিরও অনুমোদন নেই। তাই কর্তৃপক্ষ ফিটনেসও পরীক্ষা করে না। চালকদেরও নেই কোনও লাইসেন্স। ফিটনেসবিহীন এসব স্পিডবোট প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে। দুর্ঘটনা ঘটলেও দ্রুত নদী পারের জন্য নিরুপায় হয়ে যাত্রীরা পদ্মা পাড়ি দিতে স্পিডবোটে ওঠেন। তবে, এসব দুর্ঘটনা ও হতাহতের কোনও পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৩-২০১৯ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৯টি দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত, ৭৭ জন আহতসহ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন। তবে এ বছরেই স্পিডবোটের চার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে চার জন। আহত হন ৪৬ জন।

দুর্ঘটনার কারণ: নিবন্ধনবিহীন স্পিডবোটের চালকদের নেই কোনও লাইসেন্স। ফলে প্রায়শই নদীর মাঝে স্পিডবোটের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। কখনও কখনও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা না থানায় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের স্পিডবোট চালাতে দেখা যায়। রাতে স্পিডবোট চালানোর বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নৌপুলিশ ও ঘাট কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেশি ভাড়ার লোভে চালকরা স্পিডবোট চালায়। স্পিডবোটের কোনও লাইট না থাকায় অন্ধকারে কখনও ফেরির সঙ্গে কখনও বা নদীতে থাকা ড্রেজারের পাইপের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনায় পড়ে।

অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করাও দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ বলে জানা গেছে। এছাড়া স্পিডবোটে পর্যাপ্ত পরিমাণে লাইফ জ্যাকেট থাকে না। আবার লাইফ জ্যাকেট থাকলেও কিছু যাত্রীরা তা পরতে আগ্রহী না।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কাঁঠালবাড়ি ঘাটের ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) আক্তার হোসেন বলেন, ‘এই নৌপথে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ কোনও স্পিডবোট চলাচলে অনুমতি দেয়নি। তবুও সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হয় বিধায় আমরা তাদের সেভাবে কিছু বলি না। তবে রাতে স্পিডবোট চলাচলে ঝুঁকি তো আছেই, রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তারা এসব মানছে না। রাতে স্পিডবোট চলাচলের বিষয় ইউএনও, ওসিকে জানিয়েছি। কিন্তু তারাও কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।’

শিমুলিয়া ঘাটের ইজারাদার ও লৌহজংয়ের মেদেনীমন্ডল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন বলেন, স্পিডবোট নিবন্ধনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলেছি। দুই বছরের ট্রেনিং নিয়ে চালকরা স্পিডবোট চালায়। দক্ষ একজন চালকের সঙ্গে হেলপার হিসেবে কাজ করে তারপর চালক হয় তারা। মাঝে মাঝে স্পিডবোটের ইঞ্জিনের পেট্রোলে ভেজাল থাকে তাই, চালু করার সময় বন্ধ হয়ে যায়।’

এ ব্যাপারে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, ‘কোনও স্পিডবোটের নিবন্ধন নেই। তবে, আমরা শিগগির নিবন্ধন দেওয়ার চেষ্টা করছি। রাতে স্পিডবোট চালানো নিষেধ থাকলেও অনেকে নৌপুলিশকে ফাঁকি দিয়ে বোট চালায়। আমরা খবর পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই।’

মাদারীপুরের শিবচরের ইউএনও আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্পিডবোট চালাতে পারবে। এরপর কোনোভাবেই স্পিডবোট চালানোর কথা না। রাতে স্পিডবোট দেখা গেলে নৌপুলিশকে আটকাতে বলা হয়েছে। যারা রাতে স্পিডবোট চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়: স্পিডবোটের নিবন্ধন না থাকলেও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে, তাও মানে না চালক ও ঘাটের ইজারাদাররা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এ ব্যাপারে উভয়ঘাটের চিত্র একই রকম। বিআইডব্লিউটিএ জনপ্রতি ১২০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও উভয় ঘাটে চলে ইজারাদারদের রাজত্ব। তারা ভাড়া নেয় ইচ্ছেমতো। টিকিটের গায়ে ভাড়া লেখা থাকে না। ১২০ টাকার ভাড়া নেওয়া হয় ১৮০ টাকা। ঈদের মৌসুমে নেয় ২০০ টাকা। রাতে বোটে উঠলে ২০০ টাকার বেশিও নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে কাঁঠালবাড়ী স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার ইয়াকুব ব্যাপারী বলেন, ‘রাতে চলাচল তো বন্ধ থাকে। আমি অসুস্থ, রাতে ঘাটে থাকি না। ঘাটে আমার ভাগিনা রাসেল আছে। ও আপাতত সব কিছু দেখে।’অতিরিক্ত ভাড়ার ব্যাপারে লৌহজংয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছেও মাঝেমাঝে অভিযোগ আসে যে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তখন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। তবে, ঘাটে গেলে দেখতে পাই নির্ধারিত ভাড়াতেই টিকিট কাটা হচ্ছে।’ তবে ভাড়া ১২০ নয়, ১৫০ টাকা নির্ধারণ আছে বলে এ কর্মকর্তা দাবি করেন।

এদিকে, স্পিডবোটের নিবন্ধনের কার্যক্রম এক মাসের মধ্যে শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর এম মাহবুব উল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এ রুটে কোনও ধরনের নিবন্ধন ছাড়াই স্পিডবোট চলাচল শুরু হয়েছিল। আমরা ঠিক করেছি স্পিডবোটের নিবন্ধনের কাজ করা হবে। এ বিষয়ে সদ্য একটি আইনও পাস হয়েছে। চালকদেরও প্রশিক্ষণ বা কর্মশালায় অংশগ্রহণের পর লাইসেন্স দেওয়া হবে।’

অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ নির্ধারিত ভাড়া ১২০ টাকা। ইউএনও কেন ১৫০ টাকা বললেন তা আমি বলতে পারবো না। তবে, ইজারাদাররা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সভা করে ১৫০ টাকা ভাড়া করেছিল বলে শুনেছি।’